আমাদের চারপাশে অনেক কিছুই আমাদের নজর কাড়ে , মনে প্রশান্তি আনে । কলেমের খোঁচায় যেমন লেখনী ফুটে উঠে , তেমনি তুলির ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে রঙের খেলা ,মন ভোলানো ডিজাইন । যুগের পরিবর্তনে সবকিছুই এখন আধুনিক হয়েছে , সেই সাথে গ্রাফিক্স ডিজাইন ও ডিজাইনারের চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন । অন্যান্য সকল পেশা থেকে গ্রাফিক্স ডিজাইন পেশাটি ঝামেলা মুক্ত এবং বেশ নিরাপদ। কারণ , বর্তমান বাজার চাহিদা অনুযায়ী গ্রাফিক্স ডিজাইনারের কাজের অভাব খুব কমই হয় । কিন্তু অনেকেরই মনে প্রশ্ন থাকে , অন্য সব পেশা থাকতে আমি কেন গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখবো? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতেই আমাদের আজকের এই লেখা ।
আপনি যদি গ্রাফিক্স ডিজাইন শেখা ও কাজে লাগানোর কথা চিন্তা করে থাকেন, তবে বলবো সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর যদি না শিখে থাকেন, তবে এই লেখা আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে বলে আশা করি। গ্রাফিক্স ডিজাইনের প্রয়োজনীয়তা এখন সবক্ষেত্রে। ওয়েব ডিজাইন, প্রোগ্রামিং, ডিজিটাল মার্কেটিং থেকে শুরু করে ফেসবুক পেজ পরিচালনা করতেও এখন গ্রাফিক্স ডিজাইন জানা জরুরি।
যেকোনো কাজ করার বা শেখার জন্য সে বিষয়ে গুরুত্ব অনুধাবন করাটা জরুরী। কাজের গুরুত্ব জানা না থাকলে কাজের প্রেরণা এবং আগ্রহ থাকে না।
কেন গ্রাফিক্স ডিজাইন শেখা প্রয়োজনঃ
আমরা এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করতে যাচ্ছি যেগুলো জানলে আপনি অবশ্যই গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখতে চাইবেন। আসুন, কারণগুলো জানি। তার আগে ছোট্ট একটা পরিসরে “GRAPHICS DESIGN” কি সেটা জেনে নিলে কেমন হয়?
গ্রাফিক্স ডিজাইন কিঃ
গ্রাফিক্স ডিজাইন মূলত এমন একটি শিল্প যেখানে আর্ট এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ে দৃশ্যমান ছবি বা নকশা তৈরি করা হয়। গ্রাফিক্স শব্দটি আমার পেয়েছি গ্রীকদের নিকট থেকে। সেসময় গ্রীকরা ছবি আঁকার জ্ঞান বোঝাতে গ্রাফিক্স শব্দটি ব্যবহার করত। কিন্তু বর্তমান সময়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে তৈরি করা দৃশ্যমান ডিজাইনকে GRAPHICS DESIGN বলা হয়।
সাধারণত গ্রাফিক্স ডিজাইনের ক্ষেত্রে কম্পিউটার, সফটওয়্যার এবং স্কেচ প্যাড এই তিনটি জিনিস বেশি প্রয়োজন হয়। লোগো ডিজাইন, ফ্লায়ার, পোস্টার, ইউআই, বিজনেস কার্ড, বইয়ের কভার, ছবি এডিটিং, ম্যাগাজিন, পত্রিকা, টি-শার্ট ডিজাইন ইত্যাদি সবকিছু গ্রাফিক্স ডিজাইনের অন্তর্ভুক্ত।
১. সৃজনশীল পেশাঃ
ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছেন যে গ্রাফিক্স ডিজাইন একটি সৃজনশীল পেশা। শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান দিয়ে কেউ ভালো মানের গ্রাফিক্স ডিজাইনার হতে পারে না। ভালো গ্রাফিক্স ডিজাইনার হওয়ার জন্য অবশ্যই ব্যবহারিক জ্ঞান থাকতে হয়। অর্থাৎ নিয়মিত ডিজাইন চর্চা করা এবং অন্যের ডিজাইন দেখার মাধ্যমে গ্রাফিক্স ডিজাইনের জ্ঞান বৃদ্ধি পায়।
গ্রাফিক্স ডিজাইনে মুখস্থ বিদ্যা কিংবা কপি-পেস্টের সুযোগ নেই বরং এখানে আপনার নিজের সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করতে হবে। কাজেই, আপনার মধ্যে যদি আঁকা-আঁকির মতো সৃজনশীলতা থাকে, তবে আপনার GRAPHICS DESIGN অবশ্যই শেখা দরকার।
২. ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিংঃ
গ্রাফিক্স ডিজাইন শেখার সবচাইতে বড় সুবিধা হলো গ্রাফিক্স ডিজাইনের মাধ্যমে আপনি ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং করতে পারবেন। যেহেতু বর্তমান সময়ে সবকিছু কম্পিউটার এবং প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠেছে, তাই মানুষকে আকর্ষণ করতে গ্রাফিক্সের প্রয়োজন।
ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসগুলোতে গ্রাফিক্স ডিজাইনের চাহিদা অনেক বেশি, যার ফলে আয়ের পরিমাণও বেশী। গ্রাফিক্সের চাহিদা এতটাই বেশী যে, শুধু গ্রাফিক্সের কাজের জন্য বেশ কিছু জনপ্রিয় ফ্রিল্যান্সিং মার্কেট প্লেস রয়েছে।
৩. ডিজাইন বিক্রিঃ
আপনি যদি একজন প্রফেশনাল ডিজাইনার হন, তবে আপনি আপনার ডিজাইন অনলাইনে বিক্রি করার সুযোগ পাবেন। এর ফলে আপনি একবার ডিজাইন তৈরি করলে আজীবন সেই ডিজাইন থেকে অর্থ আয় করতে পারবেন। বর্তমান সময়ে অনলাইনে ডিজাইন বিক্রি করার বেশ কিছু জনপ্রিয় ওয়েবসাইট রয়েছে।
৪. স্বাধীনতাঃ
উপরের আলোচনা থেকে আশা করি আপনাদের এতটুকু বোধগম্য হয়েছে যে গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের স্বাধীনতা রয়েছে। যেমন ধরুন আপনি যখন অনলাইনে ডিজাইন বিক্রি করবেন, তখন আপনাকে কারো হুকুম মানতে হবে না। কিংবা কোনও সুনির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী কাজ করতে হবে না। আপনি কখন ডিজাইন করবেন, কিভাবে করবেন, এর সম্পূর্ণটাই আপনার নিজের ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে।
৫. চাকুরী করার সুযোগঃ
মজার ব্যাপার হলো গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের জন্যে স্বাধীনভাবে কাজ করার পাশাপাশি চাকুরী করার সুযোগ রয়েছে। গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের চাকুরীর সুযোগ সুবিধা এবং বেতনের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে থাকে। আমেরিকার Fastsigns, Inc কোম্পানি তাদের গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের ৪৫ হাজার ডলার বেতন দিয়ে থাকে। এছাড়া বোনাস ও অন্যান্য সুবিধা তো আছে।
বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়, এখানে নতুন ডিজাইনরা হিসাবে যোগ দিলেও ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকুরী করার সুযোগ রয়েছে। আর প্রফেশনাল হলে তো ১ লক্ষ টাকার উপরে বেতন পাবেন।
৬. কাজের ক্ষেত্র অনেকঃ
গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজের ক্ষেত্র কতটা বেশি আশা করি নতুন করে আর বলতে হবে না। চাকুরী এবং ফ্রিল্যান্সিং করার পাশাপাশি আপনি গ্রাফিক্স ডিজাইনের উপর কোচিং, ইনস্টিউট কিংবা আইটি ফার্ম দিতে পারবেন। রিমোট জব করার সুবিধা রয়েছে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসাবে। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ কোম্পানি তাদের ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্যে পার্টটাইম বা ফুল-টাইম গ্রাফিক্স ডিজাইনার রাখে। এসব রিমোট জব আপনি ঘরে বসে করার সুযোগ পাবেন।
চাকুরী করে গ্রাফিক্স ডিজাইনার যতটা না আয় করতে পারেন, তার থেকে বেশী আয় করা সম্ভব ডিজাইন বিক্রি এবং ফ্রিল্যান্সিং করে। ফ্রিল্যান্সিং করে কতটা আয় করা যায় তা আপনারা ফ্রিল্যান্সিং ওয়েবসাইটগুলোর দিকে একটু নজর দিলেই অনুমান করতে পারবেন।
৭. নিজের প্রতিভা প্রকাশঃ
সৃজনশীল পেশা হওয়ার সুবাদে গ্রাফিক্স ডিজাইনের মাধ্যমে আপনি আপনার নিজের প্রতিভা বিকশিত এবং প্রকাশ করার সুযোগ পাবেন। গ্রাফিক্স ডিজাইন হলো রং, আকৃতি, বৈশিষ্ট্য নিয়ে খেলা। আর এই খেলার মাধ্যমে আপনি ফুটিয়ে তুলবেন কাঙ্ক্ষিত ডিজাইন। যখন আপনি অনেক ভালো ডিজাইন করবেন, তখন মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবেন এবং নিজের আইডেন্টিও তৈরি হবে।
৮. উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন নেইঃ
অনেক পেশা রয়েছে যার জন্য উচ্চ শিক্ষা, ডিগ্রি এবং সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। কিন্তু গ্রাফিক্স ডিজাইনের ক্ষেত্রে এসবের কোন প্রয়োজন হয় না। গ্রাফিক্স ডিজাইনের জন্য প্রয়োজন শুধু দক্ষতার। গুগল, অ্যাপলের মত বড় বড় কোম্পানি তাদের গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজের জন্য অনেক নতুন নতুন লোক নেয় যাদের অনেকের উচ্চ শিক্ষা নেই।
৯. প্রতিদিন নতুন কিছু শিখাঃ
গ্রাফিক্স ডিজাইন এমন একটি বিষয় / পেশা যেখানে আপনি প্রতিনিয়ত শিখবেন , নিজের কাজে , অন্যের কাজে আপনি নিত্যনতুন আইডিয়া পাবেন । এই সেক্টরের প্রতিটি কাজই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন আর নতুনত্বে ভরপুর। যা আপনাকে সৃজনশীলভাবে দক্ষ হতে সাহায্য করবে ।
১০. ডিজাইনের চাহিদা সবসময়ঃ
অটোমেশন এর যুগে ,যখন আমরা বলছি ,যে ক্রমান্বয়ে আমাদের কাজ গুলো সব অটোমেটিক রোবটের হাতে চলে যাচ্ছে ,সেই সময়ে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে ডিজাইনের জন্য এখনও ক্রিয়েটিভিটি এবং হিউম্যান থিঙ্কিং এর প্রয়োজন। কারন রোবট সুধুমাত্র কমান্ড এবং ফিক্সড ডাটার উপর নির্ভর করে কাজ করে । কিন্তু নতুন চিন্তা , পরিবর্তন ,পরিবর্ধন এর জন্য এখনও মানুষকেই চিন্তা ভাবনা করতে হয় এবং সেটা ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে।
১১. ক্যারিয়ারের পথ দেখায়ঃ
ডিজাইনার হিসেবে শুধুমাত্র স্টুডিওতে নয় , আপনার মুল্যায়ন সব জায়গায়। গ্রাফিক্স ডিজাইন এমন কিছু যা ছাড়া কোন ব্যাবসা চালানো সম্ভব না । যে কোন ব্যাবসার প্রচার প্রচারনা , উপস্থাপন , সাজানোর জন্যও গ্রাফিক্স ডিজাইনের প্রয়োজন । যদি আপনি একটি প্রতিষ্ঠানের উপর সন্তুট না হন , তবে আপনি ফ্রীল্যান্সার হিসেবে অন্যপ্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে পারেন , যোগ দিতে পারেন ইন্টারন্যাশনাল টিমে ।
১২. মার্কেটিং এবং ব্রান্ডিং:
বর্তমান প্রতিযোগীতামুলক মার্কেটে নিজের ব্যবসাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলে ধরতে নিজ পন্যের মার্কেটিং এবং ব্রান্ডিং এর কোন বিকল্প নেই । আর এই মার্কেটিং এবং ব্রান্ডিং করার জন্য আপনার প্রয়োজন হবে গ্রাফিক ডিজাইন দক্ষতার। সৃজনশীলতা যে কোন বিজনেসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। আর সৃজনশীল কাজগুলির একটি অংশ গ্রাফিক্স ডিজাইন। গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখে শুধু ক্লায়েন্ট এর কাজই নয় , আপনার নিজের ব্যবসার ক্ষেত্রেও ব্রান্ডিং এবং মার্কেটিং এর কাজে ব্যবহার করতে পারবেন আপনার সৃজনশীল দক্ষতাকে।
১৩. রিমোট আয়ের মাধ্যমঃ
বর্তমানে বেকারত্ব যে ভাবে বাড়ছে তাতে চাকরি এখন “সোনার হরিণ”। তাই বেকারত্বের গ্লানিকে দূরে রাখতে তরুনরা এখন ঝুকে পড়ছে ফ্রীল্যান্সিংয়ে। ফ্রীল্যান্সিং এ মাধ্যমে ইনকামের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে গ্রাফিক্স ডিজাইন । ফ্রীল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে প্রতিদিন হাজার লোক শুধুমাত্র ডিজাইনের কাজ করেই আয় করছে বৈদশিক মুদ্রা। তাছাড়া এটি এমন একটা প্লাটফরম যেখানে কাজের চাহিদা দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপনি নিজেও ভালভাবে গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখে ফ্রিল্যান্সিংয়ে নিজের ক্যরিয়ার পাকাপোক্তভাবে গড়ে তুলতে পারেন এবং ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে হতে পারেন একজন সফল ফ্রীল্যান্সার ।
“বর্তমান বিশ্বে এখন প্রয়োজনের তুলনায় দক্ষ গ্রাফিক ডিজাইনারের প্রচুর অভাব। অভাব এর বিপরীতে অবস্থান করে থাকে সম্ভাবনা। সম্ভাবনা যেখানে অপরিসীম সেখানে ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত। একজন দক্ষ গ্রাফিক ডিজাইনার হয়ে অভাব পুরন করবেন আপনি, এবং সমাদৃত হবেন বিশ্বব্যাপী”